পাড়া-কঁদুলী
বিভূতিভূষণ গুপ্ত
এক আছে পাড়া-কুঁদুলী। এখন লোকেরা তার ঝগড়ার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠেচে। খালি ভাবচে, কী করে একে গ্রাম থেকে তাড়ানো যায়। গ্রামের সকলের সঙ্গেই তার কোঁদল হত। এখন গ্রামের সব লোক একদিন পরামর্শ করে দেশে দেশে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলে, জানালে, “যে এই পাড়া-কুদুলীকে ঝগড়াতে হারাতে পারবে তাকে অনেক টাকা দেব।”
পাড়ার লোকেরা মনে মনে ভাবলে যে, ঝগড়ায় হেরে গেলে হয়তো পাড়া-কুঁদুলী লজ্জায় তাদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাবে।
এখন হয়েচে কি, এক গাঁয়ে এক গরীব ব্রাহ্মণ থাকে। সংসারে তার একটি ছেলে, আর একটি বউ। তারা বড় গরীব, দিন আনে দিন খায়।
বউটি একদিন ব্রাহ্মণকে বললে – বাবা, শুনেচেন ? পাড়া-কুদুলীকে ঝগড়াতে হারাতে পারলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। তা, আমাকে কেন একবার তার সঙ্গে ঝগড়া করতে দিন না। আমি তাকে নিশ্চয় হারিয়ে দেব।
ব্রাহ্মণ বললে—সে কি হয় মা! তুমি হলে ছেলেমানুষ, আর সে হল সাংঘাতিক মেয়ে! তোমাকে সে মেরেই ফেলবে।
বউ বলল—বাবা, আমি তো তার কাছে গিয়ে ঝগড়া করব না। আপনি এক কাজ করুন। একটা নৌকা ভাড়া করুন। নৌকাটা ঘাট থেকে নদীর মধ্যে অনেক দূরে লাগাবেন, আর আমাকে একগাছা মুড়ো ঝাঁটা একপাটি ছেঁড়া জুতো দেবেন। তার পর আপনারা দেখবেন কেমন করে তাকে হারাই। কিন্তু একটা কথা, আমি যাবার পর পাড়া-কুঁদুলীকে আপনারা নদীর ধারে ডেকে আনবেন।
তখন ব্রাহ্মণ একটা নৌকো ভাড়া করে বউকে নিয়ে সেই গাঁয়ে এসে লোকেদের বললে— কোথায় তোমাদের পাড়া-কুঁদুলী, তাকে নিয়ে এসো। আমার বউ তাকে ঝগড়াতে হারাতে পারবে।
গ্রামের লোকেরা বউটিকে দেখে মনে মনে ভাবলে – এ কি আর পারবে ? যা হোক, তারা মজা দেখবার জন্য পাড়া-কুঁদুলীকে গিয়ে খবর দিল, ওগো, তোমাকে কোঁদলে হারিয়ে দিতে একটি মেয়ে এসেছে।
তাই শুনেই পাড়া-কুঁদুলী রাগে গরগর্ করতে করতে নদীর ধারে ছুটল।
এদিকে গ্রামের সব লোক নদীর ঘাটে এসে জুটেচে।
পাড়া-কুঁদুলী বললে—কই, সে পোড়ারমুখী কোথায় ?
লোকেরা নৌকার মধ্যে গাছ-কোমর বাঁধা ছোট্ট বউটিকে দেখিয়ে দিলে। সে এক হাতে জুতো আর এক হাতে ঝাঁটা নিয়ে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তাকে দেখেই পাড়া-কুঁদুলী কোমর বেঁকিয়ে আঁচল ঘুরিয়ে আঙুল মটকিয়ে গালাগালি শুরু করে দিলে। আর, বউটি কিছু না বলে একবার হাতের জুতোটি তুলে তাকে দেখায়, আবার জুতোটি নাবিয়ে ঝাঁটাটি তাকে দেখায়। যতই এই দেখে পাড়া-কুঁদুলী, ততই আরও রেগে আগুন হয়ে তাকে গালাগালি দিতে থাকে। এমনি করে সমস্ত দিন চীৎকার করে পাড়া-কুঁদুলী হাঁফিয়ে পড়ল। আর, বউটি তখনও ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকে নৌকার ওপর থেকে একবার জুতো আর একবার ঝাঁটা দেখাতে লাগলো।
তখন পাড়া-কুঁদুলী ব্রাহ্মণের বউকে নমস্কার করে বলল- ধন্যি মেয়ে বাবা, আমি তোর কাছে হার মানলাম।
এই বলে তাকে নমস্কার করে পাড়া কুঁদুলী সে-গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। গ্রামের লোকেরা তখন খুশি হয়ে। ব্রাহ্মণকে আর তার বউকে, ঢের টাকা দিয়ে খুশি করলে।