arteducation

ক্যামেরা

 ক্যামেরা 


আমাদের একটা দুর্দান্ত ক্যামেরা ছিল ছেলেবেলায়। ক্যামেরাটি আমরা ভাইয়েরা উত্তরাধিকার-সূত্রে আমাদের বাবার কাকার কাছ থেকে পেয়েছিলাম।


আসলে ঐ ক্যামেরাটি আমার বাবার কাকারও নিজের জিনিস ছিল না। ক্যামেরাটি ছিল এক পাটগুদামের সাহেবের। পাটের জেলা ছিল আমাদের, পাটের সাহেবে গিজ-গিজ করত আমাদের শহর-গঞ্জ। একবার বিলেত থেকে কী এক চিঠি এলো এক সাহেবের। চিঠি পড়ে খেপে গেলেন তিনি। নদীর ধারে সাহেবের বাংলো, বাংলোর ছাদে উঠে তিনি তাঁর সব জিনিসপত্র, ঘড়ি-ক্যামেরা, জামা-কাপড় জলে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে অনেক লোক মজা দেখছিল, তার মধ্যে আমার বাবার কাকাও ছিলেন। সবারই ইচ্ছে হচ্ছিল জলে নেমে তুলে নেয়। কিন্তু সাহেবের   সাহেব যখন বন্দুকটাও জলে ফেলে দিলেন তখন একসঙ্গে বহুলোক জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার বাবার কাকা ছিলেন দক্ষ সাঁতারু, তিনি এক ডুব-সাঁতারে এক হাতে ক্যামেরাটি অন্য হাতে বন্দুকটি তুলে বাড়ি নিয়ে আসেন। বন্দুকটির কথা পরে এখন ক্যামেরাটির কথা বলি।


আদ্যি যুগের বাক্স-ক্যামেরা সেটা। কালো চামড়া-মোড়া একটা মাঝারি বিস্কুটের টিনের আকার ছিল সেটার, কাঁচ-লাগানো মুখের কাছটা চোঙা-মতো, ওজনও ছিল দুই-তিন সের। ওজনের জন্যে ক্যামেরাটা নিয়ে একটার বেশি ছবি তুলতেই হাত টনটন করত, তখন ছবি তোলার জন্যে আর একজনকে ডাকতে হতো। আর একটা ব্যাপার ছিল, স্টার্টার টেপার পরে মিনিট-খানেক খট-খট করে শব্দ হতো জোরে, তাই ছবি তোলা ছাড়াও অন্য কাজে ক্যামেররাটার ব্যবহার হতো। কাকেরা ক্যামেরাটিকে সাংঘাতিক ভয় পেত, ওটি তুলে শাটার টিপলেই সন্ত্রস্ত হয়ে কা-কা করে ঘণ্টা তিনেকের মতো নিরুদ্দেশ হত ! ফলে বাড়িতে যখন আমসত্ত্ব বা ডালের বড়ি দেওয়া হতো তখন যন্ত্রটা খুবই কাজে লাগত ৷


ফোটোও খারাপ উঠত না। তবে ছাতা পড়েছিল, তাই একটু ঝাপসা হত ছবি। একটা অসুবিধা ছিল, কিন্তু নড়লে-চড়লে তার ছবি ধরা পড়ত না। আমাদের একটা কুকুরের ছবি তুলেছিলাম, কুকুরটা তখন লেজ নাড়ছিল, সুন্দর ফোটো এসেছিল কুকুরটার, কিন্তু লেজটি অদৃশ্য। ঘূর্ণমান লেজটি ছবিতে আসেনি। 


আমাদের ওখানে ক্যামেরাটির ফিল্ম পাওয়া যেত না, কলকাতা থেকে নিয়ে যেতে হতো। এক সময় ফিল্মের অভাবে এবং অব্যবহারে ক্যামেরাটি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। তখন ওটা কাছারি-ঘরের একটা আলমারির মাথার উপরে তোলা ছিল। একদিন একটা ষাঁড় উত্তেজিত হয়ে হঠাৎ শিং উঁচিয়ে আমাদের কাছারি ঘরে ঢুকে পড়ে। মুহুরিবাবু হাতের কাছে কিছু না পেয়ে ঐ ক্যামেরাটি তুলে ধরেন। ষাঁড়টা চোখ তুলে বিচিত্র যন্ত্রটা দেখে কেমন থতমত খেয়ে কী ভেবে শিং নামিয়ে শান্ত হয়ে ঘরের থেকে চলে যায়। সেই থেকে মুহুরিবাবু ক্যামেরাটিকে নিয়মিত ফুল-চন্দন দিয়ে পুজো করতেন, বলতেন, ‘আমার বাবা,' আমার বাবা,আমার রক্ষাকর্তা, আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।'


ফুল-চন্দনে কালো ক্যামেরাটি খুন  সুন্দর মানাত। মুহুরিবাবু বুড়ো হয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় ক্যামেরাটি নিজের সঙ্গে নিয়ে যান। তিনি বহুদিন বিগত হয়েছেন, কিন্তু ক্যামেরাটি নাকি এখনও তাঁদের দেশের বাড়িতে আছে। তাঁর গৃহদেবতা, ক্যামেরাটির নতুন নাম হয়েছে ক্যামেরেশ্বর।

Post a Comment

Previous Post Next Post