arteducation

হারিয়ে যাওয়া

 হারিয়ে যাওয়া


তারাপদ রায়


আমাদের ছোট শহরের এক প্রান্তে ছিল বিশাল এক জমিদারের প্রাসাদ। আমরা বলতাম, রাজবাড়ি। রথের সময়, সপ্তাহ ধরে বিরাট মেলা জমত সেই রাজবাড়ির উঠোনে। চারপাশের গ্রাম থেকে নদী-নালা বেয়ে কয়েকশো নৌকোয় করে দোকানিরা এসে ভিড় জমাত সেই মেলায়। আসল রথের দিন লোকসমাগত হত খুব। চারদিকে জল বলে আমরা মেলার মাঠে নৌকোয় করে যেতাম। ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে নৌকোয় করে রথের মেলায় বাড়িসুদ্ধ সকলে মিলে যাওয়া ছিল বছরের সবচেয়ে বড় মজা।


মেলার ভিড়ে অল্প -বয়সী ছেলে-মেয়েরা খুব হারাত, আবার তাদের খুঁজেও পাওয়া যেত জাদুকরের তাবুর পিছনের ভিড়ে কিংবা জিলিপির দোকানের পাশে। বেশিক্ষণ কাউকে খুঁজে না পেলে, বাড়ির লোকেরা যখন তল্লাশ শুরু করত তখন পুরো মেলাতেই একটা সাড়া পড়ে যেত, অমুক গ্রামের বা তমুক বাড়ির বাচ্চা হারিয়েছে। কখনও-কখনও ছেলেধরার গুজবও রটত।


এই রকম এক বছর মেলায় পৌঁছে আমি আর দাদা বাড়ির লোকদের থেকে আলাদা হয়ে মেলা ঘুরে দেখতে দেখতে শোরগোল শুনলাম, কাদের দুটো ছেলে হারিয়ে গেছে। সে-বছর ভরা বর্ষা, মেলার চারপাশের খালগুলোতে যেমন স্রোত, তেমন জল। ছেলে দুটো জলে ডুবে বা ভেসেও যেতে পারে এই আশঙ্কায় একদল লোক মেলার চারপাশে খাল পাড় ধরে ধরে খুঁজতে লাগল তাদের।


আমি আর দাদাও, কৌতূহলবশত, সেই অনুসসন্ধানরত দলের সঙ্গে যোগ দিলাম, যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলাম হারিয়ে যাওয়া ছেলে দুটোকে খুঁজে পাওয়ার। খালের পাশে পিছল কাদা, হাঁটা কঠিন, এদিকে ঝোপঝাড় বর্ষা পড়ে বেড়ে উঠেছে, দুটো চার আনা দামের রঙিন লাঠি কিনে আমরা দু'ভাই অন্য সকলের সঙ্গে সেই ঝোপঝাড় পিটিয়ে হারিয়ে যাওয়াদের খুঁজতে লাগলাম। আমরা যখন বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে দেখি আমাদের মুহুরিবাবু। তিনি বললেন, “তোমাদের জন্যে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। এত লোক তোমাদের খুঁজছে। এতক্ষণ তোমরা কোথায় ছিলে?”


আমি আর দাদা এবার একটু চোখ চাওয়াচাওয়ি করে বুঝে গেলাম, আসলে আমরাই সেই দু'জন যাদের সবাই খুঁজছে এবং সকলের সঙ্গে আমরা নিজেদেরই খুঁজছিলাম।

Post a Comment

Previous Post Next Post