বাঁদর ধরার জাল
কেউ যদি বলো, যত্ত সব বাজে কথা, গালগল্প, আমি নিরুপায়, আমার কিছু করার নেই। চল্লিশ বছর আগের ঘটনা এসব। কারও বিশ্বাস না হলে করবে না।
আমাদের ওদিকে আগে বাঁদর ছিল না। বাঁদরনাচের খেলা দেখাতে কখনও দু'একটা
বাদর বেদেরা নিয়ে আসত, এমনি খোলামেলা বাঁদর ছিল না। সে-বছর চৈত্র মাসে একটা গোদা বাঁদর শহরে এল, সঙের দলের সঙ্গে। গাজনের শেষে সঙের দল চলে গেল, কিন্তু বাঁদরটা রয়ে গেল আমাদের পাড়াতে, আস্তানা গাড়ল আমাদের চিলেকোঠার কার্নিশে। আমাদের শহরে সব কুকুরকেই ভোলা, আর বাদর মাত্রকেই মধু বলে সম্বোধন করা হত। আমরাও এই বাঁদরটাকে 'এই মধু, কলা খাবি', 'এই মধু, শ্বশুরবাড়ি যাবি', ইত্যাদি নানা প্রশ্নে আপ্যায়িত করতাম। নতুন নতুন বাঁদর পেয়ে সবাই খুশি।
কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে আদর-আপ্যায়ন মাথায় উঠল। মধু আমাদের বাড়ির পথে একটা বিভীষিকা হয়ে দেখা দিল। একে ওকে দাঁত খিঁচিয়ে ভয় দেখানো, শিশুদের, এমনকী, অসতর্ক বড়দের হাত থেকেও খাবার কেড়ে খাওয়া, রান্নাঘরে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকে কড়াইয়ের দুধ খেয়ে নেওয়া, এসব তো চলছিল, অবশেষে সে একদিন আমাদের পূজ্যপাদ ঠাকুরমশায়কে পুজোর ঘরে আরতি দেওয়ার সময় হাত থেকে ঘণ্টা কেড়ে নিয়ে গালে এক থাপ্পড় লাগায়।
আমাদের বাড়িতে থাকতেন কাকিমার এক দূর-সম্পর্কের মামা। প্রথম থেকেই তাঁর মধুর উপরে খুব রাগ, তার উপর এই পুরুতঠাকুর ছিলেন তাঁর ছেলেবেলার ক্লাসফ্রেন্ড। মামাবাবু প্রতিজ্ঞা করলেন, 'এই বাদরটাকে ধরে বস্তায় পুরে আমি যদি নদীর ওপারে ছেড়ে না দিয়ে আসি তাহলে আমি বামুনের ছেলেই নই।' কিন্তু বাঁদরের পিছে দৌড়ে বা লাফিয়ে বাঁদর ধরা অসম্ভব।
শেষে বুদ্ধি করে মামাবাবু জেলেপাড়ায় গিয়ে একটা মাছধরা জাল একবেলার জন্যে দশ আনা দিয়ে ভাড়া করে নিয়ে এলেন। তারপর জাল নিয়ে ছাদে উঠে তাক করে বসে রইলেন মধুর জন্যে। সন্ধের দিকে দিনের অত্যাচার সেরে যেই মধু ছাদে উঠেছে, মামাবাবু মধুকে তাক করে শূন্যে জাল ছুঁড়ে দিলেন।
মধু ধরা পড়ল বটে, কিন্তু সেই জাল উপর থেকে পড়ার সময় মামাবাবুকেও জড়িয়ে ফেলল। জালের ভেতরে মধু মামাবাবু, বাদরে-মানুষে জাপটাজাপটি, পরিত্রাহি ব্যাপার। পরে জেলেপাড়া থেকে লোক ডেকে এনে দু'জনকে উদ্ধার করতে হয়। মধুর কিছু হয়নি, কিন্তু সারাজীবন মামাবাবুর হাতে-মুখে মধুর গীত আর নখের চিহ্ন ছিল।