টাইনি
পুণ্যলতা চক্রবর্তী
ছোট্টি রোগা কুকুরটাকে উঠোনের দরজায় দেখেই মোতির মা ঝাঁটা মারতে গিয়েছিল, বিজু আর বাবলি তাকে মানা করল। কপালটা কাটা, একচোখ কানা, এক ঠ্যাং খোঁড়া—এমন করে কে মারল বেচারাকে ? মোতির মা বলল 'কার বাড়িতে হাঁড়ি খেয়েছিল, দিয়েছে তারা ঠেঙিয়ে!' একটু দুধ দিতেই চেটেপুটে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল কুকুরটা, সেই থেকে ও এখানেই রয়ে গেল ।
মা ওকে স্নান করিয়ে, ওষুধ দিয়ে, পায়ে পট্টি বেঁধে দিলেন । ক'দিনেই চোখটা খুলল, কাটা ঘা শুকোল, মচকানো পাটাও সেরে গেল—এখন বেশ খেলা করে । কোনো জিনিস ছুঁড়ে দিলে ছুটে গিয়ে মুখে করে নিয়ে আসে । পেট ভরে খেতে পেয়ে বেশ মোটাসোটা হয়েছে, তবে বাবা বললেন ও আর বড় হবে না—ঐরকম ছোট্ট জাতেরই কুকুর। ওর নাম রাখা হল 'টাইনি' (ছোট্ট); মোতির মা কিন্তু বলে ‘ডাইনি !’
নবীনপুরে বাবা কাজ করেন, ওরা ওখানেই থাকে, ছুটিতে কলকাতায় দাদুর কাছে যায় সবাই । দাদুর তো ছোটখাটো 'ফ্ল্যাট' বাড়ি, তাতে আবার বাঘা কুকুর টাইগার আছে, তাই টাইনিকে এখানেই পুরানো লোক রামুদার জিম্মায় রেখে গেল । নৌকোয় নদী পার হয়ে ওপারে রেল স্টেশন, টাইনি খেয়াঘাট অবধি ওদের সঙ্গে গেল; নৌকো ছাড়লে পরে তার কুঁই কুঁই কান্না শুনে বাবলিরও কান্না পেল ।
ঠাকুর্দা ঠাকুরমায়ের আদরে, নানারকম তামাসা দেখে, ছুটিটা কি আনন্দেই যে কাটল । বিজুর তো আর ফিরতেই ইচ্ছা করছে না, বালিরর কিন্তু খুব ভাল লাগলেও, টাইনির জন্যে বড্ড মন কেমন করছে।
ছুটির শেষে বিদায় নিয়ে সবাই ফিরে আসছে -নবীনপুরের ঘাটে রামুদা দাঁড়িয়ে আছে, তার পিছনে পাগলের মত লাফাচ্ছে আর লেজ নাড়ছে টাইনি —নৌকো থেকে নেমেই বাবলি ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। রামুদা বলল, টাইনি রোজ সকালে খেয়েই, ছুটে ঘাটে গিয়ে সারাদিন বসে থাকতো — বেলাশেষে শেষ খেয়াটি দেখে, তবে বাড়ি ফিরতো।”
বাড়িতে পৌঁছে মা দেখলেন বাবলির গলার হারটা নেই। কি হল ? কোথায় গেল ? খোঁজ ! খোঁজ। খুঁজবে কোথায় ? ট্যাক্সিতে, নৌকোয় না রেলগাড়িতে কোনখানে পড়েছে, কে জানে ! বাবা বললেন, 'পথেঘাটে গয়না পরতে তাইতো মানা করি!' মা বললেন, 'বাবলি যে কিছুতেই খুলতে চাইল না।' বাবলি কাঁদ-কাঁদ হয়ে বলল, “ঠাকুমা যে বললেন সব সময়ে পরে থাকতে!' বিজু বলল, 'বাবলি নয়তো, তুই একটা হালি।'
সবাই দুঃখ করছে, এমন সময়ে টাইনি ঘরে এল—মুখে করে কি একটা এনে সে বাবলির কোলে রাখল, আর এমন করে চারদিকে তাকাল, যেন খুব একটা বাহাদুরি করেছে—আরে, এই তো বালির সেই হারটা । তখন টাইনির আদর দেখে কে ? এমন কি, মোতির মাও বলল, 'টাইনিমনি, সোনামনি।