arteducation

চাবি হারানো

 চাবি হারানো


চাবি হারানো ছিল এক গুরুতর ব্যাপার। দশ-পনেরো দিন বাদে- বাদেই প্রায় নিয়মিত ঘটত ব্যাপারটা। চাবি হারিয়ে যেত, মা কিংবা ঠাকুমা চাবি হারিয়ে ফেলতেন। আজকাল ও লোকে চাবি হারায়। কিন্তু চাবি হারানো আর সেই সঙ্গে চাবি খোঁজার মধ্যে এখন আর তত ঘটা নেই। কারণ সবাই বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। এখন আর কেউ হলফ করে বলতে পারে না যে, বাড়ির মধ্যেই সে চাবি হারিয়েছে। রাস্তায়, অফিসে, ট্রামে-বাসে কত জায়গায় পড়ে গিয়ে থাকতে পারে সেই চাবি। তাই বাসায় খোঁজা আর তেমন জোরদার হয় না। কিন্তু তখন চাবি হারালে বাড়ির মধ্যেই হারিয়েছে। গিন্নিদের শাড়ির আঁচলে ফশকা গিঁট দিয়ে বাঁধা থাকত চাবির তোড়া। তাঁরা কদাচিৎ বাড়ির বাইরে যেতেন। শুধু পুকুরঘাটে স্নান করতে যাওয়ার সময় বা জামাকাপড় বদলাবার সময় তাঁরা চাবি আঁচল থেকে খুলে অন্য কোথাও রাখতেন।


এই সময়েই ঘটত আসল গোলমাল। আমার মা এবং ঠাকুমা দু জনেই ছিলেন চাহি সম্বন্ধে অতি সাবধানী। চাবি আঁচল থেকে খুলে খুব সাবধানে কোথাও রেখে দিতেন, বইয়ের তাকের পেছনে কিংবা বিছানার তোশকের নীচে, এই সব দুর্গম জায়গায়। এবং পরে অনেক সময়ে তাঁরা মনে করতে পারতেন না, ঠিক কোথায় চাবিটা রেখেছেন। প্রথমে আলগোছে কিছুটা খুঁজতেন, তারপরেও যদি না পেতেন তখন শুরু হত গোলমান। চারপাশে খোঁজ-খোঁজ পড়ে যেত। আমরা ছোটরা সবাই মিলে লেগে যেতাম

চাবি খুঁজে বের করার কাজে। বিছানা উলটিয়ে, খাট-চেয়ার-টেবিল সরিয়ে, আলমারি কুলুঙ্গি-তাক সমস্ত ঘেঁটে ওলটপালট করে আমরা চাবি খুঁজতাম। অনেক সময় ঘন্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত চাবি খুঁজতে, সকাল থেকে দুপুর, নাওয়া-খাওয়া মাথায় উঠত, চাবি গোঁজা চলছে তো চলছেই। তারপরে হয়তো চাবি পাওয়া যেত অন্য জায়গায়, ইঁদারার পাড়ে বা রান্নাঘরের তাকে। চাবি খোঁজার একটা নেশা ছিল। তা ছাড়া আমার মা আবার সওয়া পাঁচ আনার বাতাসার হরিলুট মানত করতেন চাবি ফেরত পাওয়ার জন্যে। ফলে সব সময় সত্যিই যে চাবি হারাত তা নয়। মা'কে একটু ভয় পেতাম, কিন্তু কখনও কখনও ঠাকুমা'র চাবি আমি আর দাদা নিজেরাই লুকিয়ে রেখে পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করে উদ্ধার করেছি। কারণ ঠাকুমা'র চাবি খুঁজে দিলে শুধু হরিলুট নয়, নগদ বখশিসও পেতাম আমরা। ঝকঝকে তামার পয়সা কিংবা ডবল পয়সা, ঠাকুমা খুঁজে পাওয়া চাবি দিয়ে। তোরঙ্গ খুলে আমাদের বের করে দিতেন। সোনার টাকার মতো উজ্জ্বল ছিল সেই সব তামার পয়সা।

Post a Comment

Previous Post Next Post